করোনাকে আমার কাছে কেন যেন আল বদর আল শামসের মতো মনে হয়। করোনাকালীন সময়টা যেন একাত্তরের ডিসেম্বর। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদাররা যখন বুঝে যায় পরাজয় অনিবার্য। তখন তারা পরিকল্পনা করলো বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেয়ার, স্বাধীনতা পেলেও যেন এই জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। পাকিস্তানিরা খারাপ হলেও তারা জানে, একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে ধ্বংস করলেই হয়। বিবেক, বুদ্ধি, চিন্তাই অন্য প্রাণী থেকে মানুষদের আলাদা করে, এমনকি মানুষ থেকে মানুষকে আলাদা করে। পাকিস্তানি হানাদাররা তাই তালিকা করলো এবং সেই তালিকা তুলে দিল আল বদর আল শামসের হাতে। নৃশংস সেই দেশীয় বাহিনী বিজয়ের আগের সপ্তাহে তালিকা ধরে ধরে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাড়ি থেকে তুলে নিল, তাদের কেউ আর ফিরে আসেননি। তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আনন্দকে ম্লান করে দেয় দুদিন আগের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে স্বজন হারানোর বেদনা।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাও যেন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ শূন্য করে দিতে এসেছে। একে একে চলে গেছেন ড. আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানী, জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, আবুল হাসনাত, খন্দকার মুনীরুজ্জামান, আলী যাকের। মৃত্যু এক অমোঘ পরিণতি। আগে আর পরে সবাইকেই যেতে হবে। করোনাকালে যারা চলে গেছেন, তাদের অকাল মৃত্যু বলা যাবে না। তবুও করোনা না এলে হয়তো আরো কিছুদিন তারা আমাদের মাথায় ছায়া হয়ে থাকতেন।

এখন সময় রুখে দাঁড়ানোর। এই বাংলাদেশে মৌলবাদীদের আর এক ইঞ্চিও ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। রুখে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের সময়ই আমরা একে একে হারিয়ে ফেলছি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের; আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে, আমাদের ভরসা হয়ে ছিলেন যারা। আলী যাকের নেই; জাতির দুঃসময়ে, রুখে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে কে আর হাঁক দেবে- জাগো বাহে কুনঠে সবায়…।

শেষ দুটি মৃত্যু নিয়ে বলি। ২৪ নভেম্বর সকালটা শুরু হলো দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামানের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে। লিখলাম বটে সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, তবে আমি মুনীর ভাইকে চিনতাম সিপিবির নেতা হিসেবে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পুরানা পল্টন মোড়ের সিপিবির সেই খোলামেলা অফিসে তাকে দূর থেকে দেখতাম। মোর্শেদ ভাই একটা ফিফটি সিসি চালাতেন। মুনীর ভাইও কি একটা ছোট মোটরসাইকেল চালাতেন? মুনীর ভাইয়ের গোটা জীবনটাই সংগ্রামের, লড়াইয়ের। মুক্তিযুদ্ধ তো করেছেনই, মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে সব প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামনের কাতারেই ছিলেন খন্দকার মুনীরুজ্জামান। করেছেন শ্রমিক রাজনীতি। মেহনতি মানুষের মুক্তিই ছিল তার জীবনের লক্ষ্য।

রাজনীতি যে নীতির রাজা, রাজা হওয়ার নীতি নয়; অল্প যে কজন মানুষ সে বিশ্বাস নিজের জীবনে ধারণ করতেন; মুনীর ভাই তাদের একজন। সমাজতন্ত্রের পতনে রাজনীতি ছাড়লেও আদর্শ ছাড়েননি। জীবনের শেষটা তার কেটেছে মানুষের মুক্তির জন্য লেখালেখি করে। লেখায়, চলনে, বলনে, চিন্তায় তিনি মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রগতিশীলতাকে ধারণ করতেন। প্রচলিত রাজনৈতিক ধারায় আস্থা হারালেও স্বপ্ন হারাননি। মানুষের ওপরই ছিল তার আস্থা। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগের বিবেকই কোনো না কোনো দলের কাছে বন্ধক দেয়া। মুনীর ভাই সেখানে ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি যা সত্য, ন্যায্য তাই বলতেন। তার চাছাছোলা আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি কোনো দলই।

মুনীর ভাইয়ের মৃত্যুর দুদিন পর ২৭ নভেম্বর ঘুম ভাঙলো আরেক ধাক্বায়। আলী যাকের আর নেই। আলী যাকের রাজনীতি করতেন না বটে। তবে মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে সব প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আলী যাকের ছিলেন অনিবার্য নাম। একাত্তরে ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর শুরু হয় আরেক যুদ্ধ- যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের লড়াই। এ লড়াইটা সর্বব্যাপী। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হলেও থেমে থাকার উপায় নেই। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশ গড়ার যুদ্ধে। আলী যাকের বেছে নিলেন মঞ্চ। বাংলাদেশের মঞ্চনাটক যে আজ বিশ্বের নজর কেড়েছে তার গোড়ার কুশিলবদের একজন আলী যাকের। বাঙালির মানস, রুচি গঠন, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম সঞ্চারিত করার কৃতিত্ব আলী যাকেরদের। আলী যাকের আসলে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার এক দারুণ প্যাকেজ। মঞ্চে তিনি মহাপরাক্রমশালী অভিনেতা ও নির্দেশক-সংগঠক। টেলিভিশনে তুমুল জনপ্রিয়, ব্যবসায় দারুণ সফল। ভালোবাসতেন প্রকৃতি, চমৎকার ছবি তুলতেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছর দেশ এক দীর্ঘ দুঃসময় পার করেছে। এই সময় জাতির জনক নিষিদ্ধ ছিলেন দেশে, স্বাধীনতাবিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীর আসন পর্যন্ত কলঙ্কিত করেছে। বিকৃত করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে এক অসাধারণ আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটে। মহৎ এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সেগুনবাগিচার একটি ভাড়া বাড়িতে যাত্রা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। আটজন মহৎপ্রাণ ট্রাস্টি গড়ে তোলেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। সেগুনবাগিচার ভাড়া বাড়ি থেকে যে প্রতিষ্ঠান এখন আগারগাঁওয়ের নান্দনিক ভবনে জাতির আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আট ট্রাস্টির প্রথম নামটি ছিল আলী যাকের। করোনা কেড়ে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আরেক ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারেক আলীকে। গত বছর চলে গেছেন আরেক ট্রাস্টি স্থপতি ও কবি রবিউল হুসাইন। অল্প সময়ে তিন ট্রাস্টিকে হারিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এখন শোকাতুর।


এমন একটা সময়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যাওয়ার মিছিল লম্বা হচ্ছে, যখন জাতি এক মহাদুর্যোগের সময় পার করছে। উগ্র মৌলবাদীদের আস্ফালন আমাদের শঙ্কিত করছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে মৌলবাদীদের এই ঔদ্ধত্য আমাদের শঙ্কাকে আতঙ্কে পরিণত করছে। মৌলবাদীদের প্রেসক্রিপশনে যখন বদলে যায় পাঠ্যসূচি, স্থানান্তরিত হয়ে যায় হাইকোর্টের সামনের ভাস্কর্য; তখন বুঝি দেশ আসলে ভয়ঙ্কর এক দুঃসময় পার করছে। সরকার কৌশল বা আপসের পথ ধরে মৌলবাদীরা এখন মাথায় উঠেছে। অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে। লাই পেয়ে পেয়ে মৌলবাদীদের বাড় এতটাই বেড়েছে, তারা আজ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার হুমকি পর্যন্ত দিতে পারে।

এখন সময় রুখে দাঁড়ানোর। এই বাংলাদেশে মৌলবাদীদের আর এক ইঞ্চিও ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। রুখে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের সময়ই আমরা একে একে হারিয়ে ফেলছি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের; আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে, আমাদের ভরসা হয়ে ছিলেন যারা। আলী যাকের নেই; জাতির দুঃসময়ে, রুখে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে কে আর হাঁক দেবে- জাগো বাহে কুনঠে সবায়…।