দেড় মাস আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীতাকুণ্ডের শুকলালহাট বাজারে প্রসব বেদনা ওঠে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীর। তৎক্ষণাৎ ওই নারী সেখানকার একটি লেপতোশকের দোকানের সামনে বসে পড়েন। বিষয়টি দেখে দোকান মালিক শফি ও তার কর্মচারী লক্ষ্মী রানী দাস এগিয়ে আসেন। তারা দ্রুত একজন ধাত্রী নিয়ে আসেন। কিছুক্ষণ পর ওই নারী একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান প্রসব করেন। সন্তানসহ ওই নারীকে আশ্রয় দেন দোকান মালিক শফি।

দু’দিন থাকার পর ওই নারী সন্তান রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বিপাকে পড়েন শফি। এর পর শফি ওই শিশুটিকে লালনপালনের জন্য লক্ষ্মী রানীকে দিয়ে দেন। এর পর ঘটনাটি জানাজানি হয়। প্রসব বেদনাকালে ওই নারীর কথাবার্তায় মুসলিম বলে নিশ্চিত হন শফি। বিষয়টি জানাজানি হলে শিশুটি মুসলমান ঘরের সন্তান বলে লক্ষ্মী রানীর লালনপালনে প্রশ্ন দেখা দেয়। স্থানীয় তিনটি মুসলিম পরিবার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাদের কাছে দত্তক দেওয়ার জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত আবেদন করেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় গতকাল বুধবার একটি মুসলিম পরিবারে দত্তক দেওয়া হয় শিশুটিকে। ধর্মীয় পরিচয়ের কাছে হেরে যায় মাতৃত্ববোধ।

বুধবার ইউএনওর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ১১টার দিকে সেখানে শিশুটিকে নিয়ে আসেন লক্ষ্মী রানী দাস। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউএনও মিল্টন রায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নুর উদ্দিন রাশেদ, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফুন্নেছা বেগম, সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজীসহ কয়েকজন। আগে থেকেই উপস্থিত ছিল দত্তক নিতে আসা দুই পরিবার। এক পর্যায়ে সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুপুর ১২টার দিকে শিশুটিকে সায়েরা-আরিফ দম্পতির কাছে হস্তান্তর করা হয়। মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়েন লক্ষ্মী রানী দাস। তার আবেগঘন কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে।

বাড়বকুণ্ড ইউপি চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী বলেন, স্থানীয় কয়েকজনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ইউএনওকে বিষয়টি জানান। এর পর সমাজসেবা কর্মকর্তাকে প্রধান করে পুলিশ ও তাকে সদস্য রেখে একটি কমিটি করা হয়। দত্তকের জন্য আবেদন করা তিনজনের বিষয়ে আলোচনা শেষে বাড়বকুণ্ডের মাহমুদাবাদ এলাকার আরিফ হোসেন ও তার স্ত্রী সায়েরা বেগমের কাছে শিশুটিকে দত্তক দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আরিফ দম্পতি লক্ষ্মী রানীকে ২০ হাজার টাকা ও তিনি নিজে আরও পাঁচ হাজার টাকা দেন।

ঘটনাস্থলে থাকা সায়েরা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ১৩ বছর সংসারজীবন তাদের। কিন্তু কোনো সন্তান নেই। এ কারণে যন্ত্রণায় কাটছিল তাদের জীবন। এখন আল্লাহ তাদের কোলে ফুটফুটে ছেলেকে এনে দিয়েছেন। সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন শিশুটিকে মানুষের মতো মানুষ করতে। শুক্রবার ধর্মী রীতিতে তার নাম রাখা হবে। তিনি জানান, তার স্বামী আরিফুর রহমান একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ী।

তবে উপজেলা কমিটির এ সিদ্ধান্ত মানেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন লক্ষ্মী রানী দাস। তার বক্তব্য, তিনি শিশুটিকে ৪৭ দিন সন্তানের মতো লালনপালন করেছেন। তার প্রতি প্রবল মায়া জন্মে গেছে। শিশুটিকে ফিরে পেতে প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হবেন বলেও উপস্থিত সবার সামনে ঘোষণা দেন।

চট্টগ্রাম নেছারীয়া কামিল মাদ্রাসার প্রধান মুফতি ড. মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন আল আজহারী বলেন, যদি কোনো অভিভাবকহীন শিশু সন্তানের ধর্মীয় পরিচয় মুসলিম নিশ্চিত হয়, তবে তাকে মুসলিম সচ্ছল পরিবারের কাছে দত্তক দেওয়া যাবে।

ইউএনও মিল্টন রায় বলেন, উপজেলা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিশুটিকে লালনপালনে যোগ্য দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে তার বিষয়ে খেয়াল রাখবে কমিটি।