আগামী ২৮ ডিসেম্বর প্রথম দফায় দেশের ২৫টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মধ্য জানুয়ারিতে হবে দ্বিতীয় দফায় পৌরসভা নির্বাচন। এভাবে পর্যায়ক্রমে সবগুলো পৌরসভার নির্বাচন হবে। ভোটগ্রহণ হবে ইভিএমের মাধ্যমে। প্রশ্ন হলো, স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে কিনা? ভোটাররা নির্বিঘ্নে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন কিনা? ভোটের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার অবসান ঘটবে নাকি তাতে নতুন মাত্রা যোগ হবে? নির্বাচন কমিশন তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে যত্নবান ও আন্তরিক হবে নাকি যেমন চলছে তেমনি চলা অব্যাহত থাকবে?

স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনও এখন দলীয়ভাবে হচ্ছে। দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়। দলীয় প্রতীক নিয়েই প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে যান। দলের এবং প্রার্থীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা জয়-পরাজয় নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু গত কয়েক বছরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। নির্বাচনটা এখন অনেকটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। যারা ক্ষমতায় থাকে তারাই জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে। নির্বাচন কমিশন শাসকদের ইচ্ছাপূরণের যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। জাতীয় নির্বাচন কিংবা স্থানীয় নির্বাচন- সব ক্ষেত্রেই একটি অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে।

যেকোনো উপায়ে সরকারে যাওয়ার চেষ্টা যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টাও সমর্থন করা যায় না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাময়িক সুবিধা পাওয়া গেলেও সেটা টেকসই হয় না। ইতিহাসের বিকৃতি যেমন অপরাধ, তেমনি ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করাও মার্জনীয় হতে পারে না।

নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। মানুষ ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কমে যাচ্ছে। যে ভোট একসময় মানুষের কাছে উৎসবের মতো ছিল, এখন তা পরিণত হয়েছে আতঙ্কের বিষয়ে। ভোট নিয়ে মানুষের এই নেতিবাচক মনোভাব গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। ভোটে যদি জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটতে দেওয়া না হয়, তাহলে নির্বাচন ব্যবস্থাই শুধু ভেঙে পড়ে না, গণতন্ত্রও মজবুত ভিত্তি পায় না। বিজয়ের মাসে অনুষ্ঠিতব্য পৌর নির্বাচন নিয়ে যেকোনো বিতর্ক মুক্তিযুদ্ধের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকেই বিদ্রূপ করবে। আমরা আশা করবো, অতীতের কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুতে আসন্ন পৌর নির্বাচন ভূমিকা রাখবে।

দুই.
এবার পৌরসভা নির্বাচনে একক প্রার্থী মনোনয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। একক প্রার্থী নিশ্চিত করার তাগিদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একাধিকবার দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছেন বলেও জানা গেছে। তবে কাজের কাজ কিছু হয়েছে কিনা, সেটা বোঝা যাবে আসন্ন নির্বাচনে। ২৫ পৌরসভার মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া এবং প্রত্যাহারের পর জানা যাবে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হন কিনা। আগে এমন অনেক ঘটেছে। অনেক চেষ্টা করেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের বাগে আনা যায়নি। কোনো কোনো জায়গায় একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখা গেছে। এমনকি বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে দলীয় প্রার্থীর পরাজিত হওয়ারও উদাহরণ আছে। সংসদ নির্বাচনে একবার ঢাকার একটি আসনে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে জিতেছিলেন স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী হাজী সেলিম। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে তাকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এমন দৃষ্টান্ত আরো আছে।

প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ভুল হলে (জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিয়ে স্বজনপ্রীতি কিংবা অর্থের বিনিময়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিলে) দলীয় প্রার্থীর জয়লাভ কঠিন হয়ে পড়ে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতি নমনীয়তা দেখানোর কারণেও অনেক ক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নানা কারণে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে টানা ক্ষমতায় আছে। দলের মধ্যে একটি সুবিধাবাদী চক্র গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ অনেক ধনসম্পদেরও মালিক হয়েছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী এবং এমপি দলের কমিটি গঠনে তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এতে দলের মধ্যে একটি বিভাজন তৈরি হয়েছে। পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বও আছে। কোথাও কোথাও উপদলীয় কোন্দল বেড়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ এখন এক দলে বহু দল কিনা সে প্রশ্নও অনেকের মধ্যেই আছে।

দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব না দিলে আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতে বড় মূল্য দিতে হতে পারে। ভোটব্যবস্থা উন্নত করতে হলে, মানুষকে আবার ভোটকেন্দ্রমুখী করতে হলে আওয়ামী লীগের দলীয় শৃঙ্খলা যেমন ফিরিয়ে আনতে হবে, তেমনি জনগণের মধ্যে বিরূপতা তৈরি হয়, এমন কাজ থেকেও বিরত থাকতে হবে । আগামী জাতীয় নির্বাচনের কথা এখনই আওয়ামী লীগকে মাথায় নিতে হবে। আওয়ামী লীগ এবং সরকারকে আগামী নির্বাচনের আগে শক্ত বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করার কারণ আছে। আগের দুটি নির্বাচনে যেভাবে জয় পাওয়া গেছে, আগামী নির্বাচনে তেমনটা হবে ধরে নিলে ভুল হবে।


দেশে এখন কোনো আন্দোলন নেই। তার মানে এই নয় যে ভবিষ্যতেও মাঠ এমন শীতল থাকবে। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে এখন ভঙ্গুর অবস্থানে আছে। তার মানে এই নয় যে, সরকার নিরাপদে আছে। বিপদ কখন কোন দিক থেকে আসবে তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে রাজনীতিও উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে। সরকারের সব প্রতিপক্ষ চুলায় কড়াই চড়িয়ে আগুন দেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত। হেফাজতে ইসলামসহ মৌলবাদী উগ্রসাম্প্রদায়িক শক্তি সরকারের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে। জামায়াতে ইসলামের গোপন তৎপরতা কি সরকারের নজরদারিতে আছে? শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে নয়, পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে রাজনৈতিকভাবেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

তিন.
পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে। তবে উপনির্বাচনের মতো দায়সারা অংশগ্রহণ করবে নাকি তারা সক্রিয়ভাবেই মাঠে থাকবে, দেখার বিষয় সেটাই। বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটা প্রমাণের জন্য নামকাওয়াস্তে প্রার্থী দিয়ে শুধু অভিযোগ উত্থাপনের মধ্যে যদি বিএনপি নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে তাহলে তারা সুফলবঞ্চিতই থাকবে। যেকোনো অবস্থায় বিএনপিকে মাঠ কামড়ে থাকতে হবে এবং সব ধরনের হঠকারিতা পরিহার করে চলতে হবে। মানুষের কাছে যেতে হবে। মানুষকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জনবান্ধব হওয়ার কোনো ভালো বিকল্প নেই।

বিএনপি যে একটি জনসমর্থনপুষ্ট দল সেটা তাদের প্রমাণ করতে হবে। বিএনপির প্রতি যদি মানুষের সমর্থন থাকে, মানুষ যদি মনে করে বিএনপির প্রার্থী যোগ্য এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত তাহলে মানুষ বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করেও ধানের শীষে ভোট দিতে উৎসাহী হবে। মানুষ যদি মনে করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর চেয়ে বিএনপির প্রার্থী কোনো বিবেচনায়ই এগিয়ে নেই, তাহলে মানুষ নিরুৎসাহিত হবে। আওয়ামী লীগের চেয়ে নিজেদের ভালো প্রমাণের চেষ্টা না করে কেবল আওয়ামী লীগের নিন্দা-সমালোচনা করলে মানুষ কেন তা মেনে নেবে?

বিএনপি দাবি করে, সরকারের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোটায়। এটা সত্যি হলে তো বিএনপির জন্য সুবর্ণ সুযোগ। বিএনপিকে সরকার মাঠে নামতে দেয় না, হামলা-মামলায় তটস্থ করে রেখেছে- বিএনপির এসব অভিযোগ যদি সত্যও হয়, তাহলেও প্রশ্ন, ‘জনপ্রিয়’ দল হয়েও বিএনপি কেন এসব মোকাবিলা করতে পারে না? অধিকার কেউ কাউকে দেয় না। আদায় করে নিতে হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে কি আওয়ামী লীগকে হামলা-মামলামুক্ত রেখেছিল। মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিমের মতো নেতারা কি রাজপথে নিগৃহীত হননি? কথায় আছে, আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও।


বিএনপিকে তার নীতি-কৌশল বদলাতে হবে। অযথা হুমকিধামকি দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য শর্টকাট পথ খোঁজাও বন্ধ করতে হবে। মানুষকে ভয় না দেখিয়ে পক্ষে রাখার উপায় বের করতে হবে। সাধারণ মানুষের সচেতন সংগঠিত প্রতিরোধ ছাড়া ভোট নিয়ে তামাশা বন্ধ করা যাবে না। হৈ চৈ করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত না করে মানুষ যাতে নীরবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে মনোযোগী হতে হবে। এটা করতে পারলে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।

সরকার এবং সরকারি দলকেও মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করার পথেই হাঁটতে হবে। পৌরসভা নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীরা অধিক সংখ্যায় জিতলেও সরকার বদল হবে না। যেকোনো উপায়ে সরকারে যাওয়ার চেষ্টা যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, তেমনি যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টাও সমর্থন করা যায় না। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাময়িক সুবিধা পাওয়া গেলেও সেটা টেকসই হয় না। ইতিহাসের বিকৃতি যেমন অপরাধ, তেমনি ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করাও মার্জনীয় হতে পারে না